আমাকে চিনতে পেরে চায়ের দাম নেননি দোকানি: মীম

সংগীতশিল্পী শেখ শাহরিন সুলতানা মীমের সঙ্গে বাউল সম্রাট লালন ফকিরের এক আশ্চর্য সংযোগ আছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে সবাই জানেন ‘লালন-কন্যা মীম’ নামে। সংগীতের সঙ্গে সখ্যতাটা আগে থেকে হলেও জনপ্রিয়তার শুরুটা লালন ফকিরের বিচরণভূমি ওই কুষ্টিয়ার মাটিতে বসে। ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মীম ক্যাফেটেরিয়ায় বসে একদিন কণ্ঠে তুলেছিলেন, ‘এক চোখেতে হাছন কান্দে…’ গানটি। মুহূর্তেই তা ঝড় তুলেছিল ফেসবুকে। এরপর কেটে গেছে কয়েকটি বছর। ফেসবুকে প্রতিভার জানান দিয়ে সবার নজরে আসা শিল্পীদের মধ্যে এখন মীম অন্যতম। সম্প্রতি এই গায়িকা কথা বলেছেন ঢাকা মেইলের সঙ্গে। কথোপকথনে উঠে এসেছে তার সংগীত জীবনের নানা গল্প।

গানের শুরু…
ছোটবেলা থেকেই গান পছন্দ করতাম। ক্যাসেটে গান শুনে শুনে শিখতাম। এভাবেই গানের সঙ্গে সখ্যতার শুরু। তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গান শিখি জেদের বশবর্তী হয়ে।

কী রকম জেদ?
ছোটবেলায় আমি স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণ করতাম। আমার গান সবাই পছন্দ করতেন। শিক্ষকরাও প্রশংসা করতেন। কিন্তু প্রশংসা পেলেও প্রথম, দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় স্থান অধিকার করতে পারতাম না। এটা দেখে আমার মনে হলো, আমি হয়ত গান শিখিনি, বাজাতে পারি না বলে ওই স্থানে যেতে পারছি না। তখন মনে জেদ চাপে। গান শিখেই জয়ী হবো এমন পণ করে বসি। ওই জেদ থেকেই বাসায় বাবা-মায়ের কাছে কান্নাকাটি করি গান শিখতে। এভাবে আমার প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গান শেখা শুরু। দশম শ্রেণি পর্যন্ত আমি চারজন শিক্ষকের কাছে উচ্চাঙ্গসংগীত, ক্লাসিক্যালসহ সংগীতের বিভিন্ন বিষয়ে পাঠ নেই।

গানে শেখার পর কি প্রথম স্থান অধিকার করতে পেরেছিলেন?
হ্যাঁ, এরপর থানা ও জেলা পর্যায়ে অনেক প্রতিযোগিতায় আমি প্রথম স্থান অধিকার করেছি।

আপনি কি কোনো রিয়েলিটি শোয়ে নাম লিখিয়েছিলেন?
চ্যানেল আইয়ের ‘বাংলার গান’ -এ অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু বরিশাল থেকে নির্বাচিত হয়ে ঢাকায় আসার পর আর অংশ নিতে পারিনি। কারণ সেদিন আমার মায়ের অপারেশন ছিল। এরপর আর কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া হয়নি। একটা সময় বলা যায়, গান থেকেই দূরে চলে গিয়েছিলাম।

আবার শুরু করেন কবে থেকে?
ক্যাম্পাসে গিয়ে। পহেলা বৈশাখসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করতাম। কিন্তু সেসময় আমাকে তেমন কেউ চিনত না। পরে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় সংগীত প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করায় আমাকে আমার ডিপার্টমেন্ট থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তখন ক্যাম্পাসে আমার একটা পরিচিতি আসে। সেসময় আমি আমাদের ক্যাফেটেরিয়ায় বসে নিয়মিত গান গাইতাম।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গান প্রকাশের শুরুটা কীভাবে হয়েছিল?
সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রথম গান দেওয়া হয় ২০১৯ সালে। সেটা আমার এক জুনিয়র ছেড়েছিল। এর পেছনে একটা গল্প আছে। ওই সময় আমি আবার গান থেকে দূরে ছিলাম। পড়াশোনার দিকে মনোযোগ বেশি ছিল। তখন ফাহিম নামে আমার ওই জুনিয়র একদিন আমাকে ফোন করে ক্যাফেটেরিয়ায় যেতে বলে। আমি গিয়ে দেখি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওর পরিচিত এক জুনিয়র গেছে। ওরা আমাকে গান গাইতে বলে। ক্যাফেটেরিয়ায় বসে সেদিন ওদের কয়েকটা গান শেনাই। ‘এক চোখেতে হাছন কান্দে…’ গানটা করার সময় ফাহিম ভিডিও করে ফেসবুকে ছেড়ে দেয়। আমি এসবের কিছুই জানতাম না। কারণ তার কিছুদিন আগে আমার দুটি ফোনই চুরি হয়ে যায়। সেকারণে ফেসবুক লগইন করার সুযোগ ছিল না। এরইমধ্যে একদিন আমার বড় ভাই ফোন করে বলেন, তুই কি কোনো গান ছেড়েছিস ফেসবুকে? সেটা তো ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ২৫ হাজার লোক দেখেছে। এরপর আমি খোঁজ নিয়ে দেখি ওই গানটা ফাহিম ছেড়েছে। সবমিলিয়ে গানটার ২৭ লাখ ভিউ হয় ফেসবুকে।

আমাকে চিনতে পেরে চায়ের দাম নেননি দোকানি: মীম

এরপর কি নিয়মিত গান প্রকাশ করা শুরু করেন?
না। প্রথম গানটা ভাইরাল হওয়ার পর সে বছর ফেসবুকে আর কোনো গানই প্রকাশ করিনি। কারণ আমার আশেপাশের সবাই বলতে থাকেন, একটি গান যেহেতু ভাইরাল হয়েছে সেহেতু এখন নিয়মিত গান দিলে অনেকে ভাববে ভাইরাল হওয়ার জন্যই এগুলো করছি। সবার কথামতো আমি গান প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকি।

ফেসবুক পেজ নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন কবে থেকে?
এটা ২০২০ সালে। ফাহিম আমাকে বলল, যেহেতু আমার গান সবাই পছন্দ করে অতএব আবার শুরু করা উচিত। এরপর আমি ‘লালন কন্যা মীম’ নামে পেজ খুলি। এক্ষেত্রে ফাহিমই আমাকে সব সহযোগিতা করে। পেজের এডমিনও সে আর আমি। তবে প্রথমদিকে খুব একটা সাড়া পাচ্ছিলাম না। এতে বেশ হতাশ হই। এরমধ্যে করোনাকাল শুরু হয়। বাড়িতে বসে অলস সময় কাটছিল। তখন পেজে নিয়মিত হতে থাকি, লাইভ করতে থাকি। আস্তে আস্তে সবার সাড়া পেতে থাকি। নেটিজেনরা প্রশংসা করতে থাকেন। আমারও উৎসাহ বেড়ে যায়। এখন তো দেড় লাখ ফলোয়ার রয়েছে পেজটিতে।

এরপরের পথচলাটা কেমন ছিল?
আমার প্রথম ভিডিও ভাইরাল পর জি সিরিজ থেকে ডেকেছিল। প্রতিষ্ঠানটির ব্যানারে একটি লালন সংগীত প্রকাশ পায় আমার কণ্ঠে। তা ছাড়া এখন স্টেজ ও টিভি শো করা হচ্ছে। তবে খুব বেশি না। বেছে বেছে স্টেজ করছি। নিজের মৌলিক গান নিয়েও কাজ করছি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে নেটিজেনদের কাছে আপনার পরিচিত আছে। চলার পথে এটা কেমন প্রভাব ফেলে?
আমি সাধারণত সবার কাছে ‘লালন কন্যা’ হিসেবে পরিচিত। কোথাও গেলে দেখা যায় অনেকেই এসে কথা বলেন, আমি লালন কন্যা মীম কি না জানতে চান, ছবি তোলেন। এই আনন্দটা বলে বোঝানোর মতো না। যেমন একবার ঘুরতে গিয়েছি। সেখানে চা খাচ্ছি। চায়ের দোকানি আমাকে চিনে ফেলেছেন। তিনি আমার থেকে চায়ের দাম নেননি। দিতে গেলে বলেন, আপনার গান আমাদের ভালো লাগে। আপনার থেকে বিল নেব না।

আজকাল ফেসবুক, ইউটিউব থেকে গান গেয়ে আয় করা যায়। এটা একজন শিল্পীর জন্য কতটা সহায়ক?
আমি এই বিষয়টা আগে জানতাম না। জানার পর দেখি আমার পেজ মনোটাইজেশনের উপযোগী। তখন আমি আবেদন করলে ওরা মনোটাইজেশন দিয়ে দেয়। এরমধ্যে কিছু সম্মানি পেয়েছি এখান থেকে। আমি মনে করি এটা একজন কন্টেন্ট ক্রিয়েটরের জন্য খুব সহায়ক। কেউ যদি এখানে একটু সময় ও শ্রম দেন তবে নিয়মিত একটা স্যালারী পেতে পারেন।

ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?
আমার পড়াশোনা এখনও শেষ হয়নি। পড়ালেখাটা ঠিক রেখে গান করে যেতে চাই। শুদ্ধ সংগীতের সঙ্গে থাকতে চাই।

90 thoughts on “আমাকে চিনতে পেরে চায়ের দাম নেননি দোকানি: মীম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *